top of page
Search
Writer's picturescience Arguments

প্রতিসাম্য (symmetry) এবং ভগ্ন প্রতিসাম্যের (broken symmetry) খেলা

Updated: Jul 16, 2022


আইজ্যাক নিউটন নিজেকে এক সময় প্রশ্ন করেছিলেন যে কোনো পদার্থ যা আমাদের হাতের সামনে উপস্থিত, সেই একই পদার্থ যদি মহাকাশের অন্য স্থানে থাকে সেই পদার্থ কি একই ধর্ম প্রকাশ করবে! এখানে ধরে নেওয়া যায় স্থান এবং পদার্থ, সমজাতীয় এবং আইসোট্রপিক। গ্যালিলিও গ্যালিলাই, রেনে ডেসকারটেস এনাদের মতন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা সিমেট্রি বা প্রতিসাম্য শব্দটির হয়ত সরাসরি প্রয়োগ করেননি, তবে সেইরকমই কিছু একটা ওনারা ভেবেছিলেন এটাই অনুমান করা যায়। প্রতিসাম্য বিষয়টি আমাদের জীবনের সাথে বিশেষভাবে জড়িত। পদার্থবিদ্যায় প্রতিসাম্য শব্দটির যে বিশেষ গুরুত্ব আছে তা যারা পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাঁরা আরো ভালো বলতে পারবেন। তবে কিছুটা বাড়িয়ে বললে এটা বলা যায় পদার্থবিদ্যার অধ্যয়ন মানেই প্রতিসাম্য নিয়ে অধ্যয়ন। অন্তত নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ফিলিপ অ্যান্ডারসন তাঁর লেখা বিখ্যাত প্রবন্ধ More is different, যা ১৯৭২ সালে সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, এইভাবেই প্রতিসাম্যকে বর্ণনা করেছিলেন। নিম্ন তাপমাত্রার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার সময়ে এটা পরিস্কার হয় তাপমাত্রা কমানোর সাথে পদার্থের বিভিন্ন দশার পরিবর্তন হয়। এই যেমন জল থেকে বরফ, সাধারণ পরিবাহী থেকে অতিপরিবাহী, সাধারণ তরল থেকে অতিতরল, বা বিভিন্ন চৌম্বক দশার পরিবর্তন। দশার পরিবর্তন বিষয়টি যারা মৌলিক গবেষণা করেন তাঁদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কারণ নতুন নতুন দশার খোঁজ পাওয়াই মৌলিক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ন দিকও বটে। বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার আগে আমরা দশার পরিবর্তন সম্পর্কে আরেকটু জেনে নি। কারণ প্রতিসাম্য বিষয়টিকে বুঝতে তা কাজে লাগবে। আমরা ঘরে যে জল দেখি, উদাহরণ হিসেবে, তার তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে যদি ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পরিবর্তিত করি, তাহলে জলের দশার কিছুই পরিবর্তন হতে আমরা দেখব না। জলের অণুগুলি একটু বেশি গতিতে চলাফেরা করবে এই যা, তা আমরা খালি চোখে হয়ত বুঝতেই পারব না। এতে জলের দশার কিছুই পরিবর্তন হবে না, জল সেই জলই থাকবে। তার রঙের কোনো পরিবর্তন হবে না, তার আকারের কোনো পরিবর্তন হবে না। যে পাত্রে রাখা ছিল সেই পাত্রেই একই ভাবে থাকবে। পাত্র বদলালে যে নতুন পাত্রে ঢালা হবে, নতুন পাত্রের আকার নেবে। আবার নতুন পাত্র থেকে পুরানো পাত্রে আনলে জলের একই অবস্থায় থাকবে। স্থানের পরিবর্তনের জন্যে মোদ্দা কথা জলের কিছুই পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব না। অথচ কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস জলের তাপমাত্রা পরিবর্তন করা হয়েছে। ঠিক একইভাবে যদি পাত্রে রাখা জলের উপর বাইরে থেকে সামান্য চাপ প্রয়োগ করা হয়, সেক্ষেত্রেও দেখা যাবে জলের দশার কিছু পরিবর্তন হল না। কিন্তু একই জলের তাপমাত্রা যদি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে -১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে জলের আকার, আকৃতি সব কিছুই আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। জল তখন বরফে পরিণত হয়েছে। একেই বলা হয় পদার্থের এক ধরণের দশার পরিবর্তন। মানে একটি স্থিতি দশা থেকে অন্য একটি স্থিতি দশায় চলে এল। দশার এই পরিবর্তনের ঘটনাটি আমরা চাক্ষুষ দেখলাম বা পরীক্ষাগারে দেখা যায়। কিন্তু কেন এইরকমটি ঘটে! এই বিষয়টিওতো আমাদের জানা দরকার। জল, অতিপরিবাহী, অতিতরল এবং চুম্বক এদের দশার পরিবর্তনের কারণ যদি আমরা গভীরে জানতে চাই তাহলে প্রতিসাম্য শব্দটি বার বার উঠে আসে। মূলত এদের বিভিন্ন অবস্থাকে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রতিসাম্যের বিভিন্ন নিয়মাবলীকে কাজে লাগানো হয়। বর্তমান গবেষণায় মূলত কঠিন পদার্থের গবেষণার ক্ষেত্রে বিভিন্ন এমারজেন্ট বা উত্থানশীল ঘটনা আজ শুধুমাত্র যে মৌল গবেষকরাই বিশেষ নজরে দেখছেন বা তাঁদের মূল আকর্ষণের বিষয় সেটা বলা হলে পুরো কাহিনী হয়ত বলা হল না। দার্শনিকদেরও গবেষণার এই দিকটি বিশেষ টানে। কারণ অতি সহজ একটি কঠিন পদার্থের যেখানে অসংখ্য অণু,পরমাণু আছে, তাঁদের মধ্যে উপস্থিত অসংখ্য ইলেকট্রন একে অন্যের সাথে বিশেষভাবে জড়িত। ফলত উত্থানশীল ঘটনা আমাদের সামনে আসে সেই পদার্থের বিভিন্ন প্যারামিটার বদলানো হলে। এই ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্যে প্রতিসাম্যের যুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়। অন্তত বলা যায় প্রতিসাম্যের গাণিতিক ব্যাখার অনেক সুযোগ, সুবিধা নিয়ে আসে যা এইসব এমারজেন্ট বা উত্থানশীল ঘটনাবলীকে বুঝতে সাহায্য করে। বিষয়টিকে প্রাথমিক স্তরে এইভাবে বলা যায় পদার্থের কোনো একটা নতুন দশায় পৌঁছানো মানে তার প্রতিসাম্যেরও বদল। প্রতিসাম্য ভেঙ্গে, কমে বা বদলে গেলে, এরই সাথে পদার্থের বিভিন্ন ধর্মেরও আমুল পরিবর্তন ঘটে, পদার্থের দশারও পরিবর্তন হয়।

প্রতিসাম্যের বিষয়ে আলোচনা শুরু করলে হেরমান ওয়াইলের নাম নিশ্চিত উঠে আসার কথা। হেরমান ওয়াইল ছিলেন একজন জার্মান গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ এবং দার্শনিক। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অনবদ্য অবদান রেখে গিয়েছেন যেমন স্থান, কাল, পদার্থ, দর্শন, লজিক, প্রতিসাম্য, এবং গণিতের ইতিহাস। এই সবক্ষেত্রেই তাঁর অবদান কিছুতেই ভোলা সম্ভব নয়। অবশ্য প্রতিসাম্যকে তিনি কিছুটা অন্যভাবেই দেখেছিলেন। তাঁর Symmetry নামক বইটি প্রমাণ করে এই বিষয়ের উপর তাঁর দখল কি মারাত্মক রকমের ছিল। তাঁর মতে সৌন্দর্য এবং প্রতিসাম্য একসাথে আবদ্ধ। প্রতিসাম্য একটি বিরাট বিষয়, এর ব্যাপ্তি অনেক, শিল্পকলা এবং প্রকৃতি সবক্ষেত্রেই এর তাৎপর্য অস্বীকার করার জায়গা নেই, প্রতিসাম্যের শিকড় হল সেই গণিত। তাই প্রতিসাম্যকে বুঝতে গেলে গণিতের সাহায্য নিতেই হয়। প্রতিসাম্য শব্দটি শুধু পদার্থবিদ্যায় নয় জীবনেও এর বিশেষ গুরুত্ব আছে। জীবনকে বা জীবনের উৎপত্তিকে বুঝতে গেলেও প্রতিসাম্যকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তাই প্রতিসাম্য বিষয়টিকে একটু গভীরে আমাদের জানা এবং বোঝা দরকার। প্রথমে জানার চেষ্টা করি প্রতিসাম্য শব্দটির অর্থ কি!

খুব সহজভাবে বললে, কোনো একটি পদার্থকে বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন দৃষি্টকোণ থেকে দেখলেও যদি বস্তুটিকে আপাতভাবে একই মনে হয়, তখন আমরা বলতে পারি বস্তুটি প্রতিসাম্য। আর একটু টেকনিক্যাল শব্দ প্রয়োগ করে বলা যায়, কোনো একটি পদার্থকে ভিন্ন ধরণের পরিবর্তন করবার পরে, যেমন ঘূর্ণন, ইনভারশন বা উল্টানো, স্থান পরিবর্তন, কালের পরিবর্তন বস্তুটির ধর্ম যদি অপরিবর্তিত থাকে তাহলে বলা যায় পদার্থটি প্রতিসাম্যতা বজায় রেখেছে। আমরা বাংলায় বলছি প্রতিসাম্য, যা সিমেট্রি শব্দের অনুবাদ। সিমেট্রি শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ symmetros থেকে, যার অর্থ well-proportioned বা harmonious। প্রতিসাম্য হল একটি তুলনার বিষয়। মানে কোনো বস্তু প্রতিসম কিনা তা একমাত্র বলা সম্ভব যখন তাকে তুলনা করা হয় অন্য কারোর সাপেক্ষে, মূলত একটি অপ্রতিসম বস্তুর সাথে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের হাতে যদি একটি গোলাকার ফুটবল থাকে, ফুটবলটি যদি একই বর্ণের হয় এবং ফুটবলটির ভূতলে যদি কোনো ভিন্নতা না থাকে। সেই ফুটবলকে আমরা যদি এদিকে ওদিকে ভিন্ন ভাবে ঘোরাতে থাকি, আমরা যেভাবেই ঘোরাই না কেন, ফুটবলটি কিন্তু ঘোরানোর আগে এবং পরে একই রকম লাগবে আমাদের কাছে। আমরা কিছুই আলাদা করতে পারবো না তার প্রাথমিক এবং অন্তিম দশার মধ্যে। আমরা বলব ফুটবলটি এতো কিছু ঘটার পরেও তার প্রতিসাম্যতা বজায় রেখেছে। কিন্তু তবু একটি প্রশ্ন থেকে যাবে কার পরিপ্রেক্ষিতে সে তার প্রতিসাম্যতা বজায় রেখেছে। প্রতিসাম্যতা মাপা তখনই সম্ভব যখন তাকে তুলনা করা হয়, একটি অপ্রতিসাম্য পদার্থের সাথে, একটি অপ্রতিসাম্য জীবিত অথবা নির্জীব বস্তুর সাথে, এটা স্থান এবং কালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

আরো কয়েকটি সহজ উদাহরণ দিয়ে প্রতিসাম্যতা বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা যাক। একটি বৃত্তকে তার কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে কোনো তল কল্পনা করলে আমরা যতো তলই আঁকিনা কেন ওই কেন্দ্রের সাপেক্ষে, সেই তলের নজরে বৃত্তটির প্রতিসাম্যতা থাকবে। যদি একটি সমবাহু এবং সমকোনি ত্রিভুজকে ভিন্ন ভাবে দেখলেও আমাদের একই রকম লাগবে। কিন্তু যদি একটি চতুর্ভুজ নি, তাহলে তার প্রথম এবং অন্তিম দশার মধ্যে আমরা কিছুতেই আলাদা করতে পারব না, যদি চতুর্ভুজটিকে ১৮০ ডিগ্রি তার কেন্দ্রের সাপেক্ষে ঘোরানো হয়। ঠিক একইভাবে একটি বর্গক্ষেত্রের বেলায়, সেই ঘূর্ণন হবে ৯০ ডিগ্রি। তবে বলা যাবে বর্গক্ষেত্রটি ৯০ ডিগ্রি ঘূর্ণনের পরে সে প্রতিসাম্যতা বজায় রাখবে। এইরকম আরও অনেক জ্যামিতিক বস্তু নিয়ে বিষয়টিকে ভাবা যেতে পারে। একটি রিং বৃত্তের সাথে প্রতিসম। আবার বিষয়টি একটু জটিলও করা যেতে পারে। একটি সলিড সিলিন্ডার এবং একটি ফাঁকা সিলিন্ডার একটি টেবিলের উপর একই ভাবে গড়িয়ে যেতে পারে। বাইরে থেকে না জানা থাকলে তাদেরকে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু এদের ধর্ম তরলে এক প্রকার হবে না। যেমন ফাঁকা সিলিন্ডারটি কোনো তরলে ভেসে থাকতে পারবে, কিন্তু সলিড সিলিন্ডারটি তরলে ডুবে যাবে।


ছবিতে অসীম সংখ্যার তল বৃত্তের কেন্দ্র দিয়ে চলে গিয়েছে। প্রতিটি তলের সাপেক্ষে সিস্টেমটি প্রতিসম।


জীবনে চলার পথে আমরা প্রতিসাম্যকে আবার কিছুটা অন্যভাবে দেখে থাকি। একটি সিস্টেমে, সে নির্জীব হোক অথবা সজীব,সেখানে যদি প্রতিসাম্যতা না থাকে, তখন তার সজীবের কাছে আকর্ষণের আংশিক ঘারতি দেখা দেয়। হলুদ সূর্যমুখী ফুলটি যখন ফুটে থাকে, সেই ফুলের পাপড়িগুলি এক অদ্ভুত প্রতিসাম্যতা বজায় রাখে। বিভিন্ন ফুলগুলি শুধু তাদের বর্ণ, গন্ধ সুন্দর নয় এর সাথে সাথে তারা প্রতিসমও। ফুলের গর্ভপত্রে থাকে সুন্দর গঠনবিন্যাস। তাতেও থাকে এক অদ্ভুত প্রতিসাম্য। মৌমাছির চাকে থাকে ষড়ভুজাকার প্রতিসাম্য। নারী-পুরুষের অলঙ্কারের মধ্যেও থাকে আবর্তনশীল প্রতিসাম্যতা। মানুষের শারীরিক গঠন সেখানেও আছে প্রতিসাম্য। প্রজাপতির গঠন সেখানেও আছে। আসলে মানুষ এবং কিছু অন্যান্য প্রজাতি প্রতিসম প্যাটার্নের প্রতি একটু বেশিই আকর্ষিত হয়। এখানেও সেই আসছে কোনো অপ্রতিসম প্যাটার্নের সাথে তার তুলনা। কারণ হল অবশ্যই বৈজ্ঞানিক। যে কারণটি প্রথমেই মাথায় আসে তা হলো সজীব পদার্থের সৃষ্টির শুরু থেকে বিবর্তনের পথটি ছিল প্রগতিশীল। বিবর্তনের কথাই যদি মেনে নি তবে একে অপরকে আকর্ষণের অথবা প্রভাবিত করার প্রচেষ্টাতো খুব সহজাত। এবারে যদি ধরে নি একে অন্যকে প্রভাবিত করবার জন্যে কিছু এক অদৃশ্য জৈবিক সংকেত একে অন্যকে পাঠানো হয়, বা প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে বিবর্তনের একটি অংশ হিসেবেই খুব স্বাভাবিক ভাবেই আসে প্রতিসাম্য। কোনো বস্তু থেকে আলো এসে কোনো জীবের চোখে পড়ে। এই আলো আবার কম্পাঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নয়, এবং আলোর সংকেত যায় মস্তিস্কে। এখন মানা যায় যে নিয়ম, নীতি মেনে বিভিন্ন তরঙ্গ-দৈর্ঘের আলো বস্তু থেকে প্রথমে আমাদের চোখে এবং তারপরে মস্তিস্কে আসে, এবং সেই ক্ষেত্রে যে প্রতিক্রিয়া তা এক অদৃশ্য সূত্র। এইভাবে একে অন্যের প্রয়োজনেই আসে প্রতিসাম্য যা নিয়ে আসে নির্দিষ্ট কিছু গঠনবিন্যাস। পুরো বিষয়টিকে আবার এইভাবেও বলা যেতে পারে একটি সিস্টেম প্রতিসাম্যতা বজায় রাখা মানেই প্রাকৃতিক কিছু নিয়মকে মেনে চলা।



ছবিতে কয়েকটি সাধারণ প্রতিসাম্যের তুলনা করা হয়েছে। (a) একটি বর্গক্ষেত্র প্রতিসম তার ৯০ ডিগ্রি ঘূর্ণনের ফলে। (b) আয়তক্ষেত্রটি প্রতিসম ১৮০ ডিগ্রি ঘূর্ণনের পরে। (c) বর্গক্ষেত্রটি প্রতিসম এই বিন্দুযুক্ত রেখার সাপেক্ষে যে প্রতিফলন হবে। (d) এই চিত্রটি ৯০ ডিগ্রি ঘূর্ণনের ফলে প্রতিসম। কিন্তু যে কোনো প্রতিফলনেই এর কোনো প্রতিসাম্যতা নেই। (e) বৃত্তকে যে কোনো কোনেই ঘোরানো হোক না কেন তা প্রতিসম। (f) রিঙের সমান প্রতিসাম্যতা বৃত্তের সাপেক্ষে। (g) এই ছবির কোনোই প্রতিসাম্যতা নেই। ( ছবির ধারণা Juan Maldacena )


পদার্থবিদ্যায় এবং সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানে যে সমস্ত সার্বজনীন নীতি আছে তারা স্থান এবং কালের বিচারে প্রতিসাম্য। খুলে বললে ঠিক এইরকম দাঁড়ায় সার্বজনীন নীতিগুলি অপরিবর্তিত থাকে স্থান বদল করলে। এবং সেই নীতি আজকে যা আছে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে এবং অতীতেও তাই ছিল। যেদিন থেকে সময়ের শুরু, সময় শুধু এগিয়ে চলেছে এটা ধরে নিলে, তবে থেকেই সেই সার্বজনীন নীতিগুলি প্রতিসম। হাইড্রোজেন অণু বিজ্ঞানের যে নীতি মেনে পৃথিবীতে চলে, কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে সে একই নীতি মেনে চলে। কারণ পদার্থবিদ্যার মৌলিক নীতিগুলির কোনো নির্দিষ্ট পছন্দের দিক নেই। নীতিগুলো তার প্রতিসাম্যতা বজায় রাখে তাকে ঘুরিয়ে দেওয়া হলেও, ওলট-পালট করে দেওয়া হলেও। বিজ্ঞানের সেই সমস্ত মৌলিক নীতিগুলি কোলকাতার ঘরে মাপি, হিমালয়ে মাপি অথবা সব থেকে দূরের একটি কোয়েসারে, নিয়ম নীতিগুলি একই থাকবে। এইগুলি হল প্রকৃতির মৌলিক নীতি। এ কোনো বিভিন্ন দেশের সংবিধান নয়, অথবা কোনো ধর্ম নয়, অথবা চানক্যের নীতি বাক্য নয়, যা স্থান কাল পাত্র পরিবেশ অর্থনীতি এই সবের সাথে বদলানো আবশ্যক হবে। চাণক্য মৌর্য-সাম্রাজ্যের চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে যে কূটনীতি প্রয়োগ করেছিলেন সেই অর্থনীতিকে যদি এখন কাজে লাগাতে হয়, তাহলে তাতে আবশ্যক অনেক কিছু সংযোজনের। বিজ্ঞানের মৌলিক নীতি শুধু বিজ্ঞানেরই মৌলিক নীতি। আইজ্যাক নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র, মানে যে নীতি মেনে আম মাটিতে পড়ে, একটা ঢিল আকাশে ছুড়লে যেমন মাটিতে নেমে আসে, শক্ত দেওয়ালে আঘাত হানলে যেমন হাতে আঘাত লাফে, বন্দুকের থেকে গুলি ছুড়লে যেমন মানুষ পিছিয়ে আসে, যে নীতি মেনে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে, অন্যান্য গ্রহগুলিও সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, যে নীতি মেনে জোয়ার-ভাঁটা হয়, যে নীতি মেনে চলন্ত ঘোড়া চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেলে আরোহী সামনে পড়ে যায়। স্থান কাল পাত্র ভেদে সেই সব নীতি অপরিবর্তিত থাকে মানে প্রতিসাম্যতা বজায় রাখে। আইজ্যাক নিউটন এইসব নীতিগুলির প্রস্তাবনা করেছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীতে। আজো তার যথার্থতা আছে এবং আগামীদিনেও তাই থাকবে। ঠিক তেমনই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকবাদ, আলোর গতিবেগ যে ধ্রুবক, অথবা স্থান এবং কাল মানে সময় যে ভরের জন্যে একসাথে মুচড়িয়ে যায়। এ সবই মৌলিক নীতি এবং এইগুলি সবই প্রতিসম।

আইনস্টাইন যখন প্রথমে আপেক্ষিকবাদের তত্ব বিকশিত করার চেষ্টা করেন, তিনি প্রথমে প্রতিসাম্যকে বিভিন্ন রেফারেন্স কাঠামোতে চাপিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি এমন একটি পদ্ধতি খুজতে চাইছিলেন যে ক্ষেত্রে প্রকৃতির সমস্ত মৌলিক নীতিগুলো সমস্ত প্রদর্শকের নজরে একই ঠেকবে। এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষক স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকুক, অথবা একটি নির্দিষ্ট গতিবেগ নিয়ে এগিয়ে চলুক অথবা পর্যবেক্ষক সময়ের সাথে তাঁর গতিবেগ বাড়িয়ে চলুক, যাকে বলে একটা ত্বরণ নিয়ে এগিয়ে চলুক।

প্রতিসাম্যের প্রসঙ্গে আইনস্টাইন অবশ্য প্রথমে হেঁটেছিলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সোয়েলের দেখানো পথেই। ১৮৭৯ সালে আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেন। পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সোয়েল ঠিক ওই বছরেই জীবন হারান। ম্যাক্সোয়েল একটি গাণিতিক সমীকরণকে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। কোনো স্থির তড়িৎকণা যখনই গতিবেগ পায়, সে তৈরি করে কারেন্ট। আর কারেন্ট মানেই তৈরি হয় চুম্বকীয় ক্ষেত্র। ম্যাক্সোয়েল সেই সময়ে অবস্থিত সমস্ত তড়িৎ এবং চুম্বকীয় বৈশিষ্টগুলোকে একটি সমীকরণের মাধ্যমে একত্রিত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, আলোকবিজ্ঞানেও, যাকে আমরা বলি অপটিক্স, সেখানেও তাঁর সমীকরণের প্রভাব যথেষ্ট।

স্থানে যে প্রতিসাম্য থাকে সেখানে থাকে জ্যামিতিক পদার্থের প্রতিসাম্য মানে স্থানিক বা স্থান-কেন্দ্রিক প্রতিসাম্য। আর প্রকৃতির নীতিগুলোর যে প্রতিসাম্য, সেখানে থাকে মূলত পদার্থবিদ্যাগত প্রতিসাম্য। পদার্থবিদ্যায় প্রতিসাম্য নিয়ে যে সমস্ত শব্দগুলো সাধারণত শুনতে পাওয়া যায়, সেইগুলি হলো ডিসক্রিট সিমেট্রি (বিযুক্ত প্রতিসাম্য), কনটিনিউয়াস সিমেট্রি (ধারাবাহিক প্রতিসাম্য), বাই-লেটারাল সিমেট্রি (মিরর প্রতিসাম্য), ট্রান্সলেশনাল সিমেট্রি (স্থানান্তরের প্রতিসাম্য), প্লানার সিমেট্রি (তলের প্রতিসাম্য), প্যারীটি অথবা ইনভারসান সিমেট্রি (উল্টে দেওয়ার প্রতিসাম্য), রোটেশনাল সিমেট্রি (ঘূর্ণনের প্রতিসাম্য), গেজ ফ্রিডম, টাইম-রিভারশাল সিমেট্রি (সময় উল্টে দেওয়ার প্রতিসাম্য) ইত্যাদি। কঠিন পদার্থবিদ্যায় বিভিন্ন দশার পরিবর্তন নিয়ে আমরা যখন কথাবার্তা বলি তখন আমরা ডিসক্রিট সিমেট্রি নিয়েই আলোচনা করি। ডিসক্রিট সিমেট্রির সব থেকে ভালো উদাহরণ হল যে কোনো কেলাস। কনটিনিউয়াস সিমেট্রির একটি আদর্শ উদাহরণ আমাদের মহাবিশ্ব। মহাবিশ্বের যে কোনো বিন্দু থেকে আমরা যেদিকেই যাই না কেন তা হবে প্রতিসম। আবার মহাবিশ্বের যে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনেও তা অপরিবর্তিত থাকবে, মানে প্রতিসাম্যতা বজায় থাকবে। পদার্থবিদ্যার অধিকাংশ বিভাগেই প্রতিসাম্যের বিভিন্ন নিয়মাবলীকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন নীতিগুলোকে বোঝার চেষ্টা করা হয়। প্রতিসাম্যের কিছু নিয়মকে কাজে লাগালে অনেক জটিল সমীকরণেরও কিছু সরলীকরণ হয়। সাকল্যে পদার্থবিদ্যার অনেক জটিল সমস্যাকে অনেক সহজ করে দেয় প্রতিসাম্যের সঠিক নিয়োগ। এবারে আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করব, কঠিন পদার্থের বিভিন্ন দশাকে মূলত দশার পরিবর্তনকে বুঝতে গেলে কিভাবে প্রতিসাম্যকে কাজে লাগানো যেতে পারে। সেখানে উঠে আসে ভগ্ন-প্রতিসাম্য নামক শব্দটি। পরবর্তী অংশের আলোচনা ভগ্ন-প্রতিসাম্যকে নিয়েই, যা সিমেট্রি-ব্রেকিং নামে পদার্থবিদ্যায় বিশেষ পরিচিত। (পরের অংশটি পড়ার জন্যে এই লিংকে ক্লিক করুন

338 views0 comments

Recent Posts

See All

Comments


bottom of page