বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীর লক্ষ্য হল প্রকৃতির অজানা কে জানা এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে মানব জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলা। সেই অজানাকে জানার তৃষ্ণার মধ্য দিয়েই আজ আমরা আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি পেয়েছি, যা আমাদের জীবনকে অনেক সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি নির্ভর করে তাত্ত্বিক ও পরীক্ষামূলক গবেষণার সম্মিলিত চেষ্টার উপর। এই লেখায় এমন একটা পরীক্ষামূলক কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হবে যা মৌলিক বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এবং সেই কৌশলটির নাম নিউট্রন বিক্ষীরন। এটি এমন একটি কৌশল যা কোনও পদার্থের সুনির্দিষ্ট কাঠামোর বর্ণনা দিতে পারে।
পদার্থের কাঠামো:
আমাদের জীবনে পদার্থের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে কিছু না কিছু পদার্থ ব্যবহার করি। প্রতিটি পদার্থের প্রকৃতি বা ধৰ্ম আলাদা হয়। কিছু পদার্থ কঠিন, কিছু পদার্থ ঘনীভূত, আবার কিছু পদার্থ তরল হয়। উদাহরণস্বরূপ জলকে ধরা যাক। জলের তিনটি অবস্থা রয়েছে - বরফ, জল এবং বাষ্প। শুধুমাত্র তাপমাত্রা বাড়িয়ে বা কমিয়ে জলের এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় অনায়াসে যাওয়া যায়। এমনকি শক্ত বা কঠিন পদার্থের মধ্যেও বিভিন্ন ধরণের বৈশিষ্ট্য আছে, কিছু পদার্থ শক্ত, কিছু পদার্থ নরম, কিছু পদার্থ স্থিতিস্থাপক, কিছু পদার্থ ভঙ্গুর, কিছু পদার্থ ধাতব। এখন মনে স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে - তারা সব আলাদা কেন? তাদের আলাদা রূপ হয় কেন?
বর্তমানে আমরা প্রায় সকলেই স্মার্ট মোবাইল ব্যবহার করছি, যেগুলো আকারে ছোট কিন্তু যথেষ্ট শক্তিশালী। তারা হাজার হাজার বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ দিয়ে তৈরি। প্রতিটি অংশ আবার আলাদা আলাদা পদার্থ দিয়ে তৈরি, যাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেই আকারে ছোট কিন্তু উচ্চগুন সম্পন্ন অংশগুলি এবং তাদের পদার্থগুলি দীর্ঘ এবং বিপুল পরিমান গবেষণার ফল। অন্যদিকে আজ আমরা বড় বড় বিল্ডিং, বড় বড় ব্রিজ, বড় বড় স্টেডিয়াম, মহাকাশ যান, ইত্যাদি তৈরি করছি। সেগুলোর জন্য উচ্চমানের পদার্থ দরকার যেগুলো সুদীর্ঘ্ গবেষণার ফল হিসেবে পাওয়া গেছে। এই পদার্থগুলির মান কিভাবে আরও উন্নত করা যায়? সেটাই হলো বর্তমান গবেষণার একটি মূল লক্ষ্য। পদার্থের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য তার অভ্যন্তরীণ কাঠামোর উপর নির্ভর করে। সুতরাং তাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো সম্পর্কে জানাটা খুব দরকারি। আমরা যদি তা জানতে পারি তাহলে আমাদের সেই পদার্থটিকে দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করা থেকে শুরু করে, অন্যান্য প্রয়োগমূলক কাজে তাদেরকে ব্যবহার করতে অনেক সুবিধা হয়। এখানে আমরা সেই পরীক্ষামূলক কৌশলটি – ‘নিউট্রন বিক্ষীরন’ নিয়ে আলোচনা করব যা পদার্থের সঠিক কাঠামোটি নিখুঁতভাবে জানতে ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়, এটা বললেও হয়ত বাড়িয়ে বলা হবে না, এটি অন্যান্য সম্পর্কিত কৌশলগুলির তুলনায় বেশি শক্তিশালী।
পদার্থের অভ্যন্তরীণ কাঠামো জানার জন্য আমাদের পদার্থটির ক্ষুদ্রতম অংশে যেতে হবে যা ইউনিট সেল হিসাবে পরিচিত। যেটি পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ যার পুনরাবৃত্তি পদার্থটিকে গঠন করে। তাই, ইউনিট সেল পদার্থের প্রাথমিক কাঠামো। উদাহরণ স্বরূপ নিচের চিত্রটিতে একটি ইউনিট সেল দেখানো হয়েছে যেটি একটি সাধারণ ঘনক, যার আটটি কোনে আটটি পরমাণু অবস্থিত। পরমাণুগুলির পুনরাবৃত্তিটি স্ফটিক গঠনের ল্যাটিস (lattice) হিসাবে পরিচিত। সবচেয়ে সহজ এবং সবচেয়ে প্রতিসম ল্যাটিস সিস্টেমটি হল ঘনক। অন্যান্য আরও ছয়টি ল্যাটিস সিস্টেম রয়েছে সেগুলো হলো হেক্সাগোন, টেট্রাগোন, রম্বোহেড্রাল, অর্থোরম্বিক, মনোক্লিনিক এবং ট্রাইক্লিনিক। অনেক ক্ষেত্রে, ইউনিট সেল বিভিন্ন ধরণের পরমাণু (দুই, তিন বা বহু ধরণের) দিয়ে গঠিত হয়। যার সব থেকে সহজ উদাহরণ হলো নুন (NaCl) যার গঠন একটি ঘনক (চিত্র-২)। এই ঘনক-এর অর্ধেক ল্যাটিস পয়েন্ট-এ সোডিয়াম পরমাণু এবং আর অর্ধেক ল্যাটিস পয়েন্ট-এ ক্লোরিন পরমাণু থাকে। প্রতিটি সোডিয়াম পরমাণু প্রতিসাম্য ভাবে ছয়টি ক্লোরিন পরমাণু দ্বারা বেষ্টিত এবং একই ভাবে প্রতিটি ক্লোরিন পরমাণু প্রতিসাম্য ভাবে ছয়টি সোডিয়াম পরমাণু দ্বারা বেষ্টিত। কোনো কোনো পদার্থের ক্ষেত্রে ল্যাটিসের বিন্যাস সুদূরপ্রসারী হয়, যাদের স্ফটিক বলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা সংক্ষিপ্ত দৈর্ঘ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেই সংক্ষিপ্ত দৈর্ঘ্যের ল্যাটিস যুক্ত পদার্থগুলি কে এমারফস (amorphous) পদার্থ বলে। কাঁচ হলো এমারফস পদার্থ-এর একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ।
চিত্র-১: পদার্থের অভ্যন্তরীণ কাঠামো (ইউনিট সেল) এবং ল্যাটিস স্ট্রাকচার।
চিত্র-২: নুন বা NaCl (ইউনিটসেল) -এর গঠন ।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যে ইউনিট সেলটি জানতে হবে তা আকারে খুব ছোট, যার এক এক দিকের বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় এক সেন্টিমিটারের এক কোটি ভাগের এক ভাগ। তাহলে প্রশ্ন আসবেই এত ছোট মাত্রা কিভাবে পরিমাপ করা যায়। সাধারণ পরিমাপ পদ্ধতির ক্ষেত্রে, কোন কিছু পরিমাপ করার জন্য সম-আকৃতির স্কেল-এর প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি আমাদের নোটবুকের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করি তবে আমাদের সেন্টিমিটার স্কেল প্রয়োজন। যদি আমরা ঘরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে চাই তবে আমাদের মিটার স্কেল বা ফিতের প্রয়োজন। যদি আমরা দুটি শহরের মধ্যে দূরত্ব পরিমাপ করি তবে আমাদের কিলোমিটার স্কেল প্রয়োজন। তদনুসারে, পৃথিবী থেকে বিভিন্ন্ তারা বা গ্যালাক্সির দূরত্ব এতো বেশি যে কোনো রকম সাধারণ স্কেল (কিলোমিটার বা সমতুল্য) দিয়ে মাপা যায় না। সেই জন্য এখানে দূরত্ব মাপার জন্য আলোর গতির সাহায্য নেওয়া হয়, যা আলোকবর্ষ ইউনিট দিয়ে বর্ণনা করা হয়। একইভাবে, ইউনিট সেল-এর দৈর্ঘ্য এতো ছোট যে আমরা কোনোরকম সাধারণ পদ্ধতি তথা স্কেল দিয়ে মাপতে পারি না। ইউনিট সেল-এর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে আমাদের একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে হয়, যা হলো বিক্ষীরন পদ্ধতি। পদার্থের অভ্যন্তরীণ গঠন বা পরমাণুগুলির মধ্যেকার দূরত্ব আর তাদের বিন্যাস পরিমাপ করার জন্য তাই অনুরূপ তরঙ্গদৈর্ঘ্য-এর এক্স-রে এবং নিউট্রন ব্যবহার করা হয়। এখানে বলে রাখা যাক যে এক্স-রে একটি তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ যা পদার্থের মধ্যেকার পরমাণুর ইলেকট্রন মেঘের সাথে যোগাযোগ করে এবং বিক্ষীপ্ত হয়। এভাবে এক্স-রে পদার্থের অভ্যন্তরীণ পারমাণবিক বিন্যাস তথা স্ফটিকের কাঠামোর তথ্য প্রদান করে। যেহেতু এক্স-রে পরমাণুর ইলেক্ট্রন ইলেকট্রন মেঘের সাথে যোগাযোগ করে, তাই বিক্ষীরন তীব্রতা ওই উপাদানটির পারমাণবিক সংখ্যার বর্গনুপাতিক। সুতরাং, কোনো পদার্থের মধ্যে ভারী পরমাণুর উপস্থিতিতে হালকা পরমাণুর তথ্য পাওয়া কঠিন। এই একই কারণে এক্স-রে দিয়ে পর্যায় সারণীতে দুটি প্রতিবেশী উপাদানকে আলাদা করা খুব কঠিন, কারণ তাদের থেকে সমান তীব্রতার এক্স-রে বিক্ষীরন হয়। এই সীমাবদ্ধতাগুলি নিউট্রন বিক্ষীরন দিয়ে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
চিত্র-৩: পরমাণু এবং নিউক্লিয়াসের কাঠামো। পরমাণু-এর মধ্যে নিউট্রনের অবস্থান।
চিত্র- ৪: নিউট্রন এবং এক্স-রে এর বিক্ষীরন হওয়ার ক্ষমতা বিভিন্ন উপাদান থেকে।
এখন দেখা যাক নিউট্রন কি? এটি কোথায় অবস্থিত? এর বৈশিষ্ট্যগুলি কি কি? নিউট্রন একটি মৌলিক কণা যা পরমাণুর নিউক্লিয়াস-এর ভেতরে থাকে। পরমাণুর নিউক্লিয়াস-এ নিউট্রন-এর সাথে আরও-একটি মৌলিক কণা থাকে যাকে প্রোটন বলা হয়। আর পরমাণুর নিউক্লিয়াস-এর চারিদিকে ইলেকট্রন (প্রোটন-এর সমসংখক) ঘুরতে থাকে। নিউট্রন-এর ভর (~1.67×10−27 kilograms) প্রোটন-এর ভর-এর প্রায় সমান, কিন্তু ইলেকট্রনের- ভরের চেয়ে প্রায় ২০০০ গুন বেশি। নিউট্রনের আকার প্রোটনের আকারের প্রায় সমান। অন্যদিকে, নিউট্রন একটি চার্জহীন কণা যা বৈদ্যুতিন চার্জযুক্ত ইলেক্ট্রন বা প্রোটন-এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নিউট্রনের কণা এবং তরঙ্গ উভয় আচরণ থাকতে পারে। এখানে বলে রাখতে চাই যে, যদিও এটি বিশ্বাস করা হয়েছিল যে নিউট্রন একটি মৌলিক কণা, সাম্প্রতিক গবেষণা নির্ণয় করেছে যে এটি আরও ছোট ছোট মৌলিক কণা তথা কোয়ার্ক দ্বারা নির্মিত।
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস চাদউইক ১৯৩২ সালে নিউট্রন আবিষ্কার করেন। এই নতুন কণা তথা নিউট্রনের আবিস্কার চারিদিকে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। এই নতুন কণার আবিস্কার এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ৩ বছরের মধ্যেই অধ্যাপক চাদউইক কে ১৯৩৫ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এই আবিষ্কারের অল্প-কিছুকালের মধ্যেই এই নতুন কণাটি (নিউট্রন), পদার্থবিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে ওঠে, এবং গবেষণার ধারাকে বহুলাংশে বদলে দেয়। যেমন, ১৯৩৫ সালে এনরিকো ফার্মি ‘কৃত্রিমতেজস্ক্রিয়তা’ আবিষ্কার করেন নিউট্রন এর প্রয়োগ করে। ১৯৩৮ সালে অটো হান এবং লিস মেইটনার ‘পারমাণবিকবিচ্ছেদ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। নিউট্রন বিজ্ঞান-এর অগ্রগতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক বিশেষ গুরুত্ব পালন করেছিল, যা ‘এটম বোম্ব’ বা আণবিক বোমার জন্ম দিয়েছিল। পরবর্তী কালে পারমাণবিক শক্তিকে বিভিন্ন ভাবে মানব কল্যানে- যেমন, বিদ্যুৎ তৈরি এবং আধুনিক প্রযুক্তির গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মৌলিক গবেষণায় নিউট্রনের প্রয়োগ:
নিউট্রনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এটির বিক্ষীরন ক্ষমতা, যা পর্যায় সারণীর একটি উপাদান থেকে অন্য উপাদানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা (চিত্র ৩)। যা এক্স-রে থেকে সম্পূর্ণ আলাদা যেক্ষেত্রে বিক্ষীরন ক্ষমতা উপাদানের পারমাণবিক সংখ্যার বর্গনুপাতিক। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য নিউট্রন কোনো পদার্থের মধ্যে থাকা ভারী ও হালকা উপাদানগুলিকে সমানভাবে পরিমাপ করতে পারে। এছাড়াও পর্যায় সারণীতে প্রতিবেশী উপাদানগুলি অধ্যয়ন করতেও সহায়তা করে। মজার ব্যাপার হল নিউট্রনের বিক্ষীরন ক্ষমতা একই উপাদানের আইসোটোপগুলির জন্যও পৃথক হতে পারে। এমনকি সবচেয়ে হালকা উপাদান হাইড্রোজেন থেকেও নিউট্রন খুব বেশি পরিমাণে বিক্ষীরন হতে পারে। জৈবিক পদার্থগুলির ক্ষেত্রে, যেখানে প্রচুর পরিমানে হাইড্রোজেন থাকে, এটি একটি বিশাল সুবিধা। উপরন্তু, নিউট্রন চার্জহীন কণা হওয়ার কারণে পদার্থের গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং প্রচুর পরিমাণে ভেতরের তথ্য দিতে পারে।
নিউট্রনের আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর চৌম্বকীয় মুহুর্ত যা চৌম্বকীয় পদার্থের পারমাণবিক চৌম্বক মুহুর্তের সাথে কথা বলতে পারে এবং অণুবীক্ষণিক চৌম্বকীয় কাঠামো সম্পর্কে তথ্য দেয়। অণুবীক্ষণিক চৌম্বকীয় কাঠামো বিভিন্ন ধরণের হতে পারে, যেমন ফেরো (ferro), অ্যান্টিফেরো (antiferro), ফেরি (ferri), ইত্যাদি।
নিউট্রন তরঙ্গদৈর্ঘ্য শক্তির সাথে ব্যাস্তানুপাতিক। তাই, নিউট্রনের শক্তি পরিবর্তন করে তরঙ্গদৈর্ঘ্য সহজেই পরিবর্তিত করা যায়। তাই নিউট্রন দিয়ে কেবল অ্যাংস্ট্রোম (10-10 মিটার) আকারের স্ফটিকের কাঠামো নয়, আরও অনেক বড় আকৃতির প্রোটিন, লিপিড, চৌম্বকীয় ডোমেন ইত্যাদি [যা মাইক্রোমিটার (10-6 মিটার) আকারের হয়] অধ্যয়ন করা যায়।]
এতক্ষণ আমরা শিখলাম যে পদার্থের অভ্যন্তরীণ কাঠামোটি পরমাণুগুলির বিভিন্ন বিন্যাস দ্বারা গঠিত, যেখানে পরমাণুগুলিকে স্থিতিশীল হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, পরমাণুগুলি সত্যই স্থির নয়। সাধারণ তাপমাত্রা তে তাপশক্তির কারণে পরমাণুগুলি তাদের গড় অবস্থানের চারিদিকে ক্রমাগত ঘুরতে থাকে, একে পরমাণুর স্পন্দন বলে । এছাড়াও পরমাণুর স্টোকাস্টিক গতি ও অণুর ঘূর্ণন গতি ইত্যাদি পদার্থের মধ্যে হতে পারে। পরমাণুগুলির এইসব গতিগুলি পদার্থের বাহ্যিক বৈশিষ্ট নির্ণয় করে। পদার্থের মাইক্রোস্কোপিক কাঠামোর মতো যে কোনও পদার্থের এইসব অভ্যন্তরীণ পরমাণুর গতি নিউট্রন বিক্ষীরন পদ্ধতি দিয়ে মাপা যায়।
উপরোক্ত বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য নিউট্রন বিক্ষীরন কৌশল মৌলিক গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবল ভাবে ব্যবহার হয়। ১৯৫০ সালে যখন মৌলিক গবেষণায় নিউট্রন ব্যবহার প্রথমবার শুরু হয়েছিল, তখন এর ব্যবহার শুধুমাত্র স্ফটিক এবং চৌম্বকীয় কাঠামো নির্ণয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সময়ের সাথে সাথে এর ব্যবহার বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে জীববিজ্ঞান-এ, বিস্তৃত হয়েছে।
চিত্র-৫: নিউট্রন বিম তৈরির দুটি প্রক্রিয়া, 'নিউক্লিয়ার ফিশন' এবং ‘স্পেল্লেশন প্রক্রিয়া’ ।
নিউট্রন বিম (beam) উৎপাদন:
এখন দেখা যাক পরীক্ষামূলক গবেষণার জন্য কীভাবে নিউট্রন বিম তৈরি করা হয়। গবেষণার জন্য, পর্যাপ্ত সংখ্যার নিউট্রন এর প্রয়োজন, যা মূলত দুটি পদ্ধতি দ্বারা উত্পাদিত হয়: ১. রিয়েক্টর (reactor) নিউট্রন উত্স এবং ২. স্পেল্লেশন (spallation) নিউট্রন উত্স। প্রথম পদ্ধতিটি 'নিউক্লিয়ার ফিশন' প্রক্রিয়া ভিত্তিক, যেখানে তেজস্ক্রিয় উৎস (যেমন ইউরেনিয়াম)-কে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করা হয় যার ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থের নিউক্লিয়াসটি দুটি অংশে বিভক্ত হয়, আর ২ থেকে ৩ টি নতুন নিউট্রন তৈরি করে। যদি এই প্রক্রিয়া কয়েকবার অব্যাহত থাকে তবে একটি চেইন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং বিপুল সংখ্যক নিউট্রনের সৃষ্টি হয়, যা একটি অবিচ্ছিন্ন নিউট্রন বিম উৎত্পন্ন করে। অন্যদিকে স্পেল্লেশন নিউট্রন উৎত্স এর ক্ষেত্রে, একটি টার্গেট পদার্থকে উচ্চ শক্তি সম্পন্ন প্রোটন দ্বারা আঘাত করা হয়, যা টার্গেট পদার্থ থেকে বিপুল সংখ্যক নিউট্রন বের করে, যা থেকে নিউট্রন বীম তৈরি করে। যেহেতু নিউট্রন উৎপাদন একটি খুব জটিল পদ্ধতি তাই এই ধরণের সৌকর্যের জন্যে উপযুক্ত প্রযুক্তি আবশ্যক। ফলত পৃথিবীর খুব কম জায়গায় এই ধরণের সৌকর্য অবস্থিত। চিত্র-৬ এ পৃথিবীর প্রধান প্রধান নিউট্রন বিক্ষীরনকেন্দ্র-গুলিকে মানচিত্রে দেখানো হয়েছে। পিনগুলি রিয়েক্টর-ভিত্তিক কেন্দ্র এবং তারাগুলি স্পেল্লেশন নিউট্রন কেন্দ্র। সবুজ, কমলা এবং লাল প্রতীকগুলি দিয়ে বর্তমানে চলমান, বর্তমানে নির্মাণাধীন এবং বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে এমন কেন্দ্রগুলি বোঝানো হয়েছে। ভারতবর্ষে একটি মাত্র নিউট্রন বিক্ষীরন কেন্দ্র আছে যা মুম্বাইয়ের ভাভা পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে অবস্থিত।
চিত্র-৬: বিশ্বের প্রধান প্রধান নিউট্রন বিক্ষীরনকেন্দ্রগুলি
আধুনিক প্রযুক্তিতে নিউট্রনের প্রয়োগ:
মৌলিক বিজ্ঞানে ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে নিউট্রন শক্তির উত্পাদন থেকে শুরু করে পরিবেশ ও জলবায়ু, চিকিত্সা এবং স্বাস্থ্য, ইলেকট্রনিক্স এবং আইটি ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তিতে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে, পারমাণবিক শক্তিকে সবুজ শক্তির উত্স হিসাবে বিবেচনা করা হয় যার উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। পারমাণবিক শক্তি উৎত্পাদনে ভারত বিশ্বের প্রথম ১৫ টি দেশের মধ্যে ইতিমধ্যে স্থান অধিকার করেছে। বর্তমানে ভারতবর্ষে বার্ষিক প্রায়~ 50 TWh (মোট শক্তি উত্পাদনের 2%) পারমাণবিক শক্তি উৎত্পাদন হচ্ছে, যা 2050 সালের মধ্যে 2000 TWh (মোট শক্তি উৎত্পাদনের 25%) পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। । এক TWh হল ১০ কোটি kWh এর সমান । আমাদের একটি বাড়িতে বছরে গড়ে প্রায় 90 kWh বিদ্যুৎ লাগে। তার মানে, 50 TWh বিদ্যুৎ দিয়ে প্রায় ৫০ লক্ষ পরিবারকে সারা বছর বিদ্যুৎ দেওয়া যাবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও ভারতবর্ষ বেশ কয়েকটি পারমাণবিক প্রযুক্তির বিকাশে জড়িত রয়েছে। ভারত সরকার-এর পরমাণু শক্তি বিভাগ [Department of Atomic Energy (DAE)]-এর ট্যাগ লাইন হল "জাতির সেবায় পরমাণু"। বিশেষত- স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি এবং জলের সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পরমাণু প্রযুক্তি বিকাশ করা হচ্ছে। ক্যান্সার সনাক্তকরণ ও ক্যান্সার চিকিত্সায় পারমাণবিক প্রযুক্তির বিশেষ অবদান রয়েছে। এছাড়া পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চ উত্পাদন ক্ষমতা, উচ্চ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন নতুন নতুন প্রজাতির শস্য ও ডাল বানানো হচ্ছে যার উত্পাদন ব্যয় কম। এছাড়াও, বিকিরণ প্রযুক্তি বিপুল পরিমাণে খাদ্য শিল্পে ব্যবহৃত হয় যেখানে বিকিরণিত ফল, সবজি এবং শস্য দীর্ঘকাল ধরে তাজা থাকতে পারে। বিকিরনের মাধ্যমে খাদ্যের মধ্যে থাকা ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলা সম্ভব, তার ফলে বিভিন্ন রকম সংক্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। আপাতত লেখাটি শেষ করা যায় এটা লিখে যে ভারতে পারমাণবিক প্রযুক্তি একটি দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষেত্র, যেখানে বিভিন্ন পদে প্রচুর কাজের সুযোগ রয়েছে এবং আগামী দিনে আরও আরও বেশি বেশি কাজের সুযোগ আসবে ।
Author - Dr. Anup Kumar Bera. Scientist, Bhabha Atomic Research Centre India
Comments